সত্যি যদি এমন হতো
-জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
সীতাকে রক্ষা করতে রাম লঙ্কার উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন যখন, স্বামী রূপে তিনি নিজে কি করেছিলেন একটু তো প্রশ্ন জাগেই,
‘টুকরো টুকরো অনেক পাথর সাগরে ফেলিল ছুঁড়ে
কাঠবেড়ালিও গেল না বাদ, ছুঁড়লো দু’ হাত ভরে
পাথরে পাথরে বাঁধা হলো পথ রামের যাত্রা হেতু
সেতু বন্ধনে রামের নাই হাত ভক্তেরা বাঁধে সেতু!’
অপহৃতা সীতা যদি সেতু বন্ধনের ঘটনাটি শুনে রাগে দুঃখে তাঁর স্বামীকে বলতেন,
‘অনেক খুঁজিয়া সীতাকে দেখেন অশোক মনের মাঝে,
রামেরে দেখিয়া সীতা ক্রোধে বলে কেন এসেছো এ সাঁঝে?
শুনেই রামের মাথা ওঠে ঘুরে চোখে আসে জল ভরে..
ভাবেন, সীতা এ কেমন কথা আজকে বলিল মোরে!’
তারপরও যদি বলতে পারতেন তবে হয়তো আজ আমাদের সমস্যাটা কিছু কম হোতো।
‘ক্ষমতা কিছুই নাহিকো তোমার পর ভরসাতে থাকো
ভালোমানুষের ধ্বজাখানি ধরে নিজেরে আড়াল রাখো’
সৃস্টির আদিকাল থেকে নারীর পুরুষকে স্বামী অর্থাৎ মালিক রূপে স্বীকার করে নেওয়ার ফলেই পুরুষের এমন আধিপত্য। অথচ জন্ম মূহুর্ত থেকে অন্তিম সময়টুকু পর্যন্ত নারীই তার অবলম্বন। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন ভাবে নারীই তার ভার বহন করে এসেছে। তবু আজও ‘কন্যা’ই দায়। নিজেকে নিঃশেষে নীরবে উজাড় করে দিয়ে নারী পুরুষের সংসার সৃষ্টি করেছে, রক্ষা করেছে, সুখী করেছে তবু নারী চিরদিনই দুহিতা, গ্রহীতা, অসহায়, অবলা। যে নারী সমস্ত সংসারের সহায় যার একটা দিনের অনুপস্থিতি সমস্ত সংসারকে এলোমেলো করে দেয় তাকেই পুরুষ ‘অসহায়’ আখ্যা দেয়। কি হাস্যকর তাই না! তবু নারী চিরকাল নিজের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে নিজের আজন্ম লালিত চেনা পরিচিত গণ্ডীটুকু এমনকি নিজের জন্মকালীন পরিচয়টুকুও পরিত্যাগ করে অন্য এক অপরিচিত অনাত্মীয় পুরুষের সাথে একাত্ম হওয়ার সামাজিক রীতি হাসিমুখে স্বীকার করে। সারাজীবন সুখে দুখে সমস্ত পরিস্থিতিতে তার পাশে থাকার তাকে, বলা ভালো শুধুমাত্র তাকেই না তার সমস্ত পরিবারকে সুখী করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়।
সেদিন সীতা মাতাও তাই করেছিলেন। কিন্তু যদি এইভাবে বলতে পারতেন সেদিন,
‘ভ্রাতৃ বিরোধ আশঙ্কাতে রাজ্যপাট ছেড়ে
মাতা কৈকেয়ীর অন্যায় দাবী মেনে নিলে পণ করে।
পিতৃসত্য রক্ষার নামে কাপুরুষের মতো নিজে বনে এলে,আমারে আনিলে বিপদের মাঝে শত!
কাপুরুষ সম বালিরে মারিলে পশ্চাৎ হতে তুমি,
তোমার মতো নপুংসকেরে কহিব না আর স্বামী।’
মা সীতা নিজের সতীত্বের পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হওয়ার জন্য অগ্নি প্রবেশ করেন নি। কারণ সেটা তো তার জানাই ছিলো। স্বামীর হৃদয়ে নিজের স্থানটুকু পুনর্বহাল করার তাগিদ ছিল। তিনি ঐ দুঃসহ অপমান লাঞ্ছনা মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন শুধুমাত্র স্বামীর সাথে তার পরিবারের সাথে থাকার জন্য। আজও পুরুষ প্রতি মূহুর্তে কারণে অকারণে নারীকে ঐ ভাবেই অগ্নিনিক্ষেপ করে চলেছে। আক্ষেপ জাগে সেদিন কেন সীতা বলেন নি,
“তোমার সহিত ফিরিবো না কভু এ ভুল করিতে নারি,
সাথে লয়ে গিয়ে ফেলিবে ‘আগুনে’ ভালোই বুঝিতে পারি।
অগ্নিসাক্ষী করে তুমি মোরে দিলে মর্যাদা স্ত্রীর
অথচ পারোনি রক্ষতে মোরে হেথা আনিল রাবণ বীর।
হোক সে অসুর, তবু রাবনের বীরত্ব আছে ঢের
আমি সীতা, হেন সুন্দরী নারী প্রেমে পড়ি রাবণের।
শৌর্যে বীর্যে মজিয়াছি ওগো প্রেমে হাবুডুবু আমি..
ত্যাজিলাম আজি তোমারে হে রাম..! দশাননই মোর স্বামী’
না, বলতে পারেন নি সীতা, কুসংস্কারের বশবর্তী নারীমন। নিজের ক্ষমতা কোনো দিন জানতে দেওয়া হয়নি নারীকে। পরিবর্তে বোঝানো হয়েছে ‘একা তুমি কতো অসহায়..’ তাই প্রতিক্ষণেই নারীকে তার সতীত্বের, তার নারীত্বের, তার মাতৃত্বের, তার আনুগত্যের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। আজও…… আজও……..
Onbdyo lekhoni
Speech less osadhqron sotti
ধন্যবাদ